মঙ্গলবার রাতে কলকাতার বড়বাজারে যেন মৃত্যুর ছায়া নেমে এসেছিল। রাত ৯টা ৫ মিনিটে চিৎপুর মোড়ের কাছে ঋতুরাজ হোটেলে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নেয় ছয়তলা ভবনটি। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গোটা এলাকা। দমকলের উঁচু মই আর সাহসী কর্মীদের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও থামানো যায়নি মর্মান্তিক পরিণতি। আগুনের ফাঁদে আটকে পড়া মানুষের আর্তনাদ আর নিকটজনদের উৎকণ্ঠায় ভারী হয়ে ওঠে বড়বাজারের রাত।
হোটেলের সামনে জমে ওঠে উৎকণ্ঠিত ভিড়। এক বাবা বারবার ফোন করছেন, তাঁর দুই সন্তান আর পরিবারের সদস্য আটকে ভেতরে। আরেকজনের ছেলে, হোটেলের কর্মী, ফোন ধরছেন না। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে কোনও সাড়া নেই, শুধু বাড়ছে আতঙ্ক। দমকল আর কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা দল জানালা ভেঙে, মই বেয়ে আটকে পড়াদের উদ্ধারে নামে। নীচে মাইকিং করে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা চলছে। ১১টি দমকল ইঞ্জিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, কিন্তু স্বস্তি আর মেলে না। একের পর এক নিথর দেহ বেরিয়ে আসতে থাকে হোটেলের ঘর থেকে। কেউ অগ্নিদগ্ধ, কেউ দমবন্ধ হয়ে চিরনিদ্রায়। রাত গড়িয়ে ভোর হতেই মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪-এ। অসমর্থিত খবরে এখনও তিনজন নিখোঁজ।
মৃতরা তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ আর ওড়িশার বাসিন্দা। কেউ হোটেলে থাকতে এসেছিলেন, কেউ কাজ করতেন। দুই কর্মী জানালা ভেঙে কার্নিশে নেমে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। সঞ্জয় দাস বেঁচে গেলেও মনোজ পাসোয়ানের জীবনলীলা শেষ। স্থানীয়রাও এগিয়ে এসেছিলেন। দড়ি বেঁধে, কাচ ভেঙে অনেককে উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন তারা। দমকলের মই আসার পর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম তল থেকে মানুষজনকে পাশের বাড়ির ছাদে নামানো হয়। কিন্তু ধোঁয়ার কবলে ট্রমায় থাকা অনেকেই আর বাঁচেননি। রাত ১টার দিকে দুই শিশুকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, কিন্তু তাদেরও বাঁচানো যায়নি।
দোতলায় নতুন পানশালা ও রেস্তোরাঁ তৈরির কাজ চলছিল। দমকলের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণে আগুন ছড়ায়। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার ঘাটতি আর সিঁড়ি বন্ধ থাকায় মানুষ বেরোতে পারেননি। লিফ্টও বন্ধ ছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, মালপত্র রেখে সিঁড়ি আটকানো ছিল, যা উদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা। মেয়র ফিরহাদ হাকিম রাত ৩টে পর্যন্ত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীঘা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে উদ্ধারকাজের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শোক জানিয়ে মৃতদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন, একই ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর।
লালবাজার তদন্তে সিট গঠন করেছে। হোটেলের ম্যানেজার আটক। ফরেন্সিক টিম আর পুরসভার কর্মীরা বুধবার তদন্তে নামেন। হোটেলের বাসিন্দারা মালপত্র ফেরতের আর্জি জানালেও প্রশাসন অনুমতি দেয়নি। দমকলের ডিজি রণবীর কুমার বলেন, “আগুনের উৎস দোতলার রান্নাঘর। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না, সিঁড়িও ব্যবহারের অবস্থায় ছিল না।” এই ঘটনা শুধু শোকের ছায়া ফেলেনি, বড়বাজারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

